গভীর, নিস্তব্ধ রাত। রাশিয়ায় তৈরি এসএমজি হাতে পথ দেখিয়ে চলছেন প্রিয়লাল চাকমা। পেছনে এ প্রতিবেদক। দুর্গম পর্বতময় এলাকা। যতটা সম্ভব নিশব্দে এগিয়ে চলেছি আমরা। তবু পায়ের আওয়াজে ক্ষণে ক্ষণে ভেঙে যাচ্ছে রাতের নিস্তব্ধতা। ফিসফিস করে কথা চালিয়ে যান প্রিয়লাল- আমাকে প্রথমে যারা ডেকেছে তারা একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন। ২০১৩ সালের জুনে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে তাদের একটি মিটিং হয়। সেখানে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি আমাকেসহ ৩০ জনকে বাছাই করা হয়। প্রথমে যেতে চাইনি। এ জন্য আমাকে মারাত্মক হুমকি দেওয়া হয়। একপর্যায়ে আমাকে বলা হয়, ‘তুমি যদি না যাও, তোমাকে তো বটেই, তোমার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলব।’
প্রিয়লাল ছদ্মনাম। নামধাম গোপন রাখার শর্তে আমাদের সময়কে সাক্ষাৎকার দিতে সম্মত হন পার্বত্য জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) এ সশস্ত্র সদস্য। খোলামেলা জানান পাহাড়ের গায়ের গুপ্ত অনেক কথা। অনেক অনুরোধের পর গত ২৮ নভেম্বর রাঙামাটির এক দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে রাতের আঁধারে তিনি নিয়ে যান এ প্রতিবেদককে। লক্ষ্য জেএসএসের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেদিকে এগিয়ে চলতে চলতে অনেক তথ্য উঠে আসে প্রিয়লালের কথায়। কোনো রাখঢাক ছাড়াই তিনি জানান, দেশের তিন পার্বত্য জেলায় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সক্রিয়তার কথা; তাদের নানা অপরাধমূলক কাণ্ড-কীর্তি। এ ছাড়া কোত্থেকে আসছে দামি দামি অত্যাধুনিক সব অস্ত্র; কীভাবে সেগুলো সীমান্ত পেরোচ্ছে; ওপারে কাদের যোগসাজশ রয়েছে এ অপকর্মে; দেদার চাঁদাবাজি এবং এসবের ভাগবাটোয়ারা- ইত্যাদি বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে প্রিয়লালের জবানিতে।
জানা গেছে, পার্বত্য অঞ্চলের অরক্ষিত সীমান্ত হয়ে দেশে পাচার হচ্ছে অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র ও মাদকের চালান। এম-১৬, এসএমজি, স্নাইপার রাইফেল থেকে শুরু করে রকেট লঞ্চারের মতো ভারী অস্ত্রের চালান সীমান্তের এপারে এসে চলে যাচ্ছে পার্বত্যাঞ্চলে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে। পাহাড়ি তরুণদের নানা প্রলোভনে ভেড়ানো হচ্ছে এসব গোষ্ঠীতে, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র। সশস্ত্র এসব সংগঠন তাদের সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম অবাধে চালিয়ে যেতে নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে চলছে তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। বছরের পর বছর পার হলেও পাহাড়ে তাই শান্তি আসেনি, আসেনি স্থিতিশীলতা।
এসএমজি হাতে পথ চলতে চলতে প্রিয়লাল চাকমা। তাদের এই সশস্ত্র অপতৎপরতা ঠিক কিনা জানতে চাইলে প্রিয়লাল চাকমা বলেন, ‘আমি তো মনে করি না, এটা সঠিক পথ। কিন্তু বাধ্য হয়ে এ পথে এসেছি। এখন সরে গেলে আমার পরিবারকে মেরেই ফেলবে। আমাকেও। বাধ্য হয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে। চাইলেও যেতে পারছি না।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি যোগ করেন, সংগঠনে প্রথম যখন যোগ দিই, আমাদের মতো নতুন সদস্যদের তখন অনেক অনেক স্বপ্ন দেখানো হয়, সুদিন প্রত্যাগত বলা হয়। অঙ্গীকার করা হয়, অধিকার আদায় হওয়ার পর পুলিশে চাকরি দেব। এই দেব, সেই দেব। তখন কোনো অভাব থাকবে না। এসো সবাই মিলে আমরা পার্বত্য অঞ্চলটা স্বাধীন করি।’
‘প্রথমে যারা কালেক্টর থাকে তারা চাঁদা আদায় করে। মাস শেষে কর্তৃপক্ষকে (স্থানীয় সশস্ত্র সংগঠন) জমা দেওয়া হয়। পরে আমাদের সামরিক শাখার জন্য একটি বাজেট কমান্ডারের কাছে দেওয়া হয়। পরে কমান্ডার আমাদের যা দেয়।’
প্রিয়লাল চাকমা আরও বলেন, ‘আমাদের অস্ত্রের ট্রেনিং হয়েছে সাজেকের দুর্গম অঞ্চলে। ২০১৩ সালে আমি ট্রেনিং করেছি। একে-৪৭, এলএমজি, এসএমজি, ৭.৬২ মি.মি. রাইফেল, থ্রি নট থ্রি, জি-৩, এম-১৬ রাইফেল, পয়েন্ট ২২ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, পিস্তল, মর্টার, দেশীয় পিস্তল, হ্যান্ড গ্রেনেড, মর্টার লঞ্চারের মতো অস্ত্র ব্যবহার হয়ে থাকে। জেএসএস রাঙামাটি ও বান্দরবানে এখন বেশি। তারা সংবিধান মানে না। তারা বলে, কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না, শুধু আমরা থাকব।’ তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে ঘাঁটি গেড়েছে সশস্ত্র সংগঠনের কিছু কর্মী। সেখানে তাদের পরিবারের সদস্যরাও থাকছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তিন পার্বত্য জেলায় ১৮ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত রয়েছে। দুর্গম এই অরক্ষিত সীমান্ত এলাকাকে অস্ত্র পাচারসহ নানা অপরাধের জন্য বেছে নিয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। তবে সরকার তিন পার্বত্য জেলায় ১ হাজার ২৯ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করছে। নির্মাণাধীন এই সীমান্ত সড়কের কাজ পুরো শেষ হলে নিরাপত্তা জোরদার করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) নামে আঞ্চলিক সংগঠন ছিল। সেটি ভেঙে তিনটি আঞ্চলিক সংগঠন তৈরি হয়। এগুলো হলো- জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (প্রসীত খীসা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। বর্তমানে এ চারটি সংগঠন পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে রয়েছে। প্রায় সব হত্যাকা-ের সঙ্গে উঠে আসে এই চার সংগঠনের অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের নাম। এর মধ্যে জেএসএসের সঙ্গে মিয়ানমারের আরাকান আর্মি ও আরাকান লিবারেশন আর্মির (এএলপি) সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মিয়ানমার সীমান্তে সক্রিয় এই দুটি সশস্ত্র সংগঠন পার্বত্য অঞ্চলে সক্রিয় অবৈধ অস্ত্রধারী একটি সংগঠনকে সহায়তা দিচ্ছে বলে স্থানীয় একাধিক সূত্রের বরাতে উঠে এসেছে। তবে এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করেও জেএসএসের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আলমগীর কবির আমাদের সময়কে বলেন, ‘ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের জেলায় অরক্ষিত সীমানা রয়েছে। অপারেশন উত্তরণের আওতায় দুর্গম অঞ্চলে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু অরক্ষিত সীমান্ত এলাকা খুবই দুর্গম হওয়ার কারণে অভিযানের সময় কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণ সম্পন্ন হলে এ সমস্যা থাকবে না।’
শান্তিচুক্তির ২৩ বছর : সম্ভব হয়নি সব ধারার বাস্তবায়ন
কোনো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘ ২১ বছরের সংঘাতের অবসান ঘটে। পার্বত্য অঞ্চলে বসবসকারী বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সব মানুষ শান্তিচুক্তিকে স্বাগত জানান। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত এই চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিলেন জেএসএসের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।
শান্তিচুক্তির পর কিছুদিন নীরব ছিল জেএসএস। পরে তাদের এক নেতা ঘোষণা দিয়ে ফের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী অস্ত্র জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা পালন করেনি সশস্ত্র সংগঠনগুলো। মূলত এসব সশস্ত্র সংগঠনগুলোর অপতৎপরতার কারণেই দীর্ঘ ২৩ বছরেও শান্তিচুক্তির সব ধারা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। যদিও নানা বাধা সত্ত্বেও ৭২ ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে। চুক্তির অবশিষ্ট ১৫টি ধারার আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
Leave a Reply